16 জানুয়ারি 1979 তেহরানের রাজপথে খুশির জোয়ার মুক্তির আনন্দে মাতোয়ারা সবাই দুদিন আগে যারা ছিল প্রতিপক্ষ তাদের আবেগে জড়িয়ে ধরছে মানুষ যার ছবি এতদিন মাথায় তুলে রাখতে হতো তাকে ছুড়ে ফেলেছেন অসীম আক্রোশে ইরানীদের জন্য এ যেন এক নতুন স্বাধীনতা কারণ 37 বছর ধরে ময়ূর সিংহাসন আঁকড়ে ধরে থাকা বাদশার পতন ঘটেছে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন মোহাম্মদ রেজা পাহলা যিনি শাহ নামেই পরিচিত পশ্চিমা আশীর্বাদপুষ্ট শাহ দেশের তেল খুনি গুলো তুলে দিয়েছিলেন মার্কিন ও ব্রিটিশ কোম্পানির হাতে ইসলামী ভাবধারা ছেড়ে ঝুঁকেছিলেন পাশ্চাত্যের আধুনিকতায় দুর্নীতি উচ্চাভিলাসী প্রকল্প আর অহেতুক আরম্ভরে অন্তঃসূন্য করেছেন দেশের অর্থনীতি শক্ত হাতে গলা টিপে ধরেছেন বিরুদ্ধ মতের জনসাধারণের
উপর নজরদারীর জন্য গড়ে তোলেন সাবাক নামের বাহিনী 1975 সালে তিনি রাস্তাখিজ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে বাকি সব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন অবশেষে 1978 সালে জনরোসের বিস্ফোরণ ঘটলো যার মাত্রা বুঝতে ব্যর্থ হন শাহ দমন পীড়ন চালিয়ে গেলেও এক পর্যায়ে সামরিক বাহিনী বেঁকে বসে সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে 79 জানুয়ারিতে তেহরান ছেড়ে মিশর চলে যান শাহ তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেন আনোয়ার সাদাদ সেখান থেকে শাহের গন্তব্য মরক্কোতে বাদশাহ হাসানের কাছে সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে মোহাম্মদ রেজা যান বাহামায় সেখান থেকে মেক্সিকোতে শরীরে মরণব্যাধি বাসা বেঁধেছে কয়েক বছর আগেই কান্ট্রি মোস্ট বিউটিফুল অসুস্থতা বিবেচনা করে শাহকে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশের অনুমতি দেন জিমি কার্টার এতে ক্ষোভ দানা বাঁধে ইরানে শাহ যুক্তরাষ্ট্রে যাবার দু সপ্তাহের মাথায় তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে কূটনীতিকদের জিম্মি করে বিপ্লবী ছাত্ররা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে বাধ্য হন শাহ মেক্সিকো তাকে আর নিতে রাজি হয় না শাহ আশ্রয় পান স্বৈরাচার শাসিত পানামায় সেখানেও তার উপস্থিতির প্রতিবাদে দাঙ্গা দেখা দেয় 1980 সালের মার্চে আনোয়ার সাদাতের সহায়তায় মরক্কো হয়ে মিশরে ফিরেন শাহ এখানেই তার অপারেশন হয় 27 জুলাই কায়রোর হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ইরানের শেষ শাহ হাসপাতালে বেডের নিচে এক ব্যাগ ইরানের মাটি রাখা ছিল জীবদ্দশায় তার আর স্বদেশে ফেরা হয়নি মৃত্যুর পরও সে আশা পূরণ হয়নি প্রেসিডেন্ট আনোয়ার
সাদাত রাষ্ট্রীয় আয়োজনে শাহকে শেষ বিদায় জানান তাকে সমাহিত করা হয় কাইরোর আল রিফাই মসজিদে অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস ওই মসজিদেই সমাহিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ শাহ পাহলা বাবা রেজা শাহ পাহলা ছেলের মতো তাকেও ক্ষমতাচুত হয়ে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল চার দশক আগে তিনিও পাননি জন্মভূমির মাটি 1979 সালে আরো এক স্বৈরাচারীর পতন দেখে বিশ্ব তিনি কুখ্যাত ইদিয়ামিন ইতিহাসে অন্যতম নিঃশংস বরবর ও নিরাচারী শাসক উগান্ডার ইদয়ামিন রাধুনি হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তরতড়িয়ে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকেন তিনি 1971 সালে কু করে মিল্টন উবতকে অপসারণ করে নিজেই বনে যান প্রেসিডেন্ট ইদমিন প্রথমেই পুলিশ বাহিনী ভেঙে নিজস্ব কিলার বাহিনী গঠন করেন তারা ওতে
সমর্থকদের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করেন উগান্ডার প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এশিয়ান বিশেষ করে ভারতীয়দের প্রভাব ছিল 1972 সালে এই শাসক সবাইকে উগান্ডা থেকে বের করে দেন আট বছরের শাসনামলে এক লাখেরও বেশি মানুষকে ঘুম নির্বাসন কিংবা ফাঁসি দেন এই উগান্ডান কসাই কারো কারো মতে সংখ্যাটা পাঁচ লক্ষাধিক দুর্নীতি আর উল্টাপাল্টা পদক্ষেপে উগান্ডার মুদ্রাস্ফীতি লাগাম ছাড়া হয়ে যায় 1978 সালে যা গৃহযুদ্ধ ডেকে আনে এমন সময় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন ইদয়ামিন প্রতিবেশী তানজানিয়ার একাংশ দখলে অভিযান চালান তানজানিয়া পাল্টা আক্রমণ চালালে আর তার সাথে বিদ্রোহীরা হাত মেলালে 1979 সালের এপ্রিলে রাজধানী কামপালার পতন ঘটে ঈদমিন লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফির কাছে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা
করেন এরপর সাদ্দাম হোসেনের ইরাক হয়ে ইদয়ামিনের ঠিকানা হয় সৌদি আরবের জেদ্দা কয়েক বছর জেদ্দায় চুপচাপ কাটানোর পর শয়তানি বুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ঈদে আমিনের গোপনে ছেলেকে নিয়ে চলে যান উগান্ডার পাশের দেশ জায়রেতে তাও আবার জাল পাসপোর্ট নিয়ে উদ্দেশ্য উগান্ডার বিদ্রোহকে উসকে দেয়া কিন্তু জায়রের বিমানবন্দরেই ধরা পড়ে যান তিনি ক্ষিপ্ত সৌদি সরকার তাকে ফেরত নিতে নারাজ মরক্কোর বাদশার চাপাচাপিতে পরে রাজি হয় রিয়াদ এক শর্তে বাকি জীবন নিভৃতে কাটাতে হবে শেষ 14 টা বছর ওভাবেই কেটেছে ঈদ ইয়ামিনের 2003 সালের জুলাই জেদ্দার এক হাসপাতালে কোমায় চলে যান ইদয়ামিন তার স্ত্রী উগান্ডা সরকারের কাছে মিনতি করেন শেষ সময়টুকু ঈদ
যাতে জন্মভূমিতে কাটাতে পারেন কিন্তু তার এ আবেদনও নাকচ হয় পরের মাসে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয় জেদ্দার রুয়াইস কবরস্থানে সাধারণ এক কবরে সমাহিত করা হয় একসময়ের দৌড়দণ্ড প্রতাপশালী ইদ ইয়ামিনকে ইদয়ামিনের মতোই নির্বাসিত অবস্থায় জেদ্দায় মারা যান আরেক আফ্রিকান সৈরশাসক আল আবেদিন বেন আলী মিশরের পাশের দেশ তিউনিশিয়ায় দীর্ঘ 23 বছর ক্ষমতা কুকিগত করে রেখেছিলেন সৈরশাসক বেন আলী 1987 সালে তিউনিশিয়ার স্বাধীনতার অগ্রদূত হাবিব বরগুইবাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন তিনি সংস্কারের আশা শোনালেও দ্রুতই নিপীড়ক হয়ে ওঠেন একদিকে যেমন বৈষম্য আর বেকারত্ব বাড়ছিল অন্যদিকে সম্পদের পাহাড় বাড়ছিল বেন আলী ও তার পরিবারের সদস্যদের 2010 সালে আরো শুনতে শুরু
হয় তিউনিশিয়া থেকে পুলিশের হয়রানির শিকার মোহাম্মদ বুয়াজিজির আত্মহননের পরে দেশ জুড়ে বিপ্লবের যে ঝড় উঠে তাতে উড়ে যায় বেনালীর মসনদ 2011 সালের জানুয়ারিতে সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন তিনি আশ্বাস দেন ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের কিন্তু তার কথায় আর কেউ বিশ্বাস করেনি সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ঘেরাও করলে সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন বেনালির সেনাবাহিনীও তাকে যেতে দেয়নি তবে বেন আলিফ ফ্রান্স অথবা মাল্টা যেতে চাইলেও বিমান তাকে নিয়ে যায় সৌদি আরবে সৌদি আরবের জেদ্দায় অসহায় দিন কাটতে থাকে বেনালীর ওদিকে প্রাসাদে বিপুল পরিমাণ অর্থ আর হীরা জহরত পাওয়া গেল তাকে 35 বছরের কারাদণ্ড দেয় তিউনিশিয়ার নতুন
সরকার বেনালীকে ফেরত পাঠাতে বলে সৌদি সরকারকে কিন্তু রিয়াদ তাতে সাড়া দেয়নি 2019 সালের 19 সেপ্টেম্বর জেদ্দার এক হাসপাতালে মৃত্যু হয় বেন আলীর দেশের সম্পদ লুটপাটে বেন আলী কেও ছাপিয়ে গেছে এশিয়ান এক সৈরশাসক ফিলিপাইনের ফার্দিনান্ত মার্কস বলা হয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে 10 বিলিয়ন ডলার সরিয়েছেন তিনি 1965 সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন মার্কস প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে প্রশংসা করান শুরুতে কিন্তু সে সবই ছিল বিদেশী ঋণে একসময় চাপ পড়ে অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে জনরোষ তা দমনে সামরিক আইন জারি করেন মার্কস মুখ বন্ধ করে দেন সব গণমাধ্যমের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে টানা চারবার লোক দেখানো নির্বাচনে জয়ী হন মার্কস
কিন্তু 1986 সালে চতুর্থ দফা নির্বাচনের পর শুরু হয় অপ্রতিরোদ্ধ পিপলস পাওয়ার মুভমেন্ট আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে রক্তপাত এড়াতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান তাকে বলেন দেশ ছেড়ে পালাতে মার্কস আর তার স্ত্রী ইমেলদা পালিয়ে যান হাওয়াই দ্বীপে যাওয়ার সময় বিমানে করে নিয়ে যান 22 বক্স নোট যার মূল্য 717 মিলিয়ন ডলার সাথে ছিল 300 বক্স গহনা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের হীরা মুক্তা গোল্ডবার আরো কত কি ওদিকে মার্কসরা পালিয়ে যাবার পর বিক্ষুপ্ত জনতা ঢুকে পড়ে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে সেখানে তারা অনেক বিলাসপূর্ণই পায় তবে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ইমেলদা মার্কসের জুতার সংগ্রহশালা 2700 জোড়া এক্সক্লুসিভ জুতা পাওয়া যায় সে প্রাসাদে হাওয়ায় এগিয়ে
বিলাসী জীবন কাটানো মার্কস দাবি করেন তিনি এখনো ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট একই সাথে দেশে ফেরারও তোর জোড় শুরু করেন ফোন দিয়ে আঁটতে থাকেন সশস্ত্র সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরার ওদিকে তার বিরুদ্ধে অর্থলোপাট মানবাধিকার লঙ্ঘন সহ অনেক অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে 1989 সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন মার্কস হাসপাতালে তাকে দেখতে যান ফিলিপাইনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সালভাদোর মার্কস তার কাছে দেশে মায়ের সমাধির পাশে সমাহিত হবার সুযোগ চান বিনিময়ে প্রস্তাব দেন লুট করা অর্থের 90 ভাগ দিয়ে দেওয়ার কিন্তু এমন প্রস্তাবেও কাজ হয়নি দেশে ফিরতে পারেননি মার্কস ওই বছরেই সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার দেশের যে পরিমাণ সম্পদ লুট করেন মার্কস তার এক
ভাগও ভোগ করে যেতে পারেনি অথচ ফিলিপিনোরা সেই ঋণ এখনো পরিশোধ করে যাচ্ছে পুরোপুরি শোধ হবে 2025 সালে মার্কসের মরদেহ হাওয়াই দ্বীপে সংরক্ষিত ছিল চার বছর এরপর প্রেসিডেন্ট ফিদেল রামস তার সব দেশে আনার অনুমতি দেন কিন্তু 23 বছর তা হিমাগারে সংরক্ষিত ছিল 2016 সালে স্বৈরাচারীর প্রেসিডেন্ট দূতের নির্দেশ দেন মার্কসের দেহাবশেষে সমাহিত করার রাতের আধারে সেই কাজ ছাড়া হয় ফিলিপাইনের বেশিরভাগ মানুষ এখনো মার্কসকে দেশে সমাহিত করার বিরোধী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যত স্বৈরাচারী শাসক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতিত এবং বিতাড়িত হয়েছেন কেউই জীবদ্দশায় নিজ দেশে ফিরতে পারেননি মৃত্যুর পরও ফিরতে পেরেছেন হাতে গোনা আর যারা অভ্যুত্থানের পর পালাননি বা
পালাতে পারেননি তাদের বরণ করতে হয়েছে আরো নির্মম পরিণতি নুসরাত তানি যমুনা নিউজ